আপাতত মাঠের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যাচ্ছে না বিএনপি, বরং পূর্বঘোষিত বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মসূচি পালনেই মনোযোগী দলটি। পাশাপাশি দেশের সার্বিক অবস্থা বুঝে পদক্ষেপ নেবে বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য ধরে রাখা। কেননা, জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং সহানুভূতি ও একতা প্রদর্শনের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করে বিএনপি। দলটির সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, অতি সম্প্রতি পতিত আওয়ামী লীগের তৎপরতা, বাংলাদেশ সচিবালয়ে আক্রমণ ও হামলা, দলগুলোর মধ্যে ঐক্য বিনষ্টের ষড়যন্ত্রসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দেয়। বিশেষ করে গোপালগঞ্জের ঘটনা দেশব্যাপী ঝড় তোলে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সরকারের সক্ষমতা ও অবস্থান নিয়ে তৈরি হয় নানা প্রশ্ন।
এমন পরিস্থিতিতে গত মঙ্গল ও বুধবার বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ ১৭টি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই বৈঠকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ‘সরকারের ব্যর্থতা’ নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন দলগুলোর নেতারা। সেইসঙ্গে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য ধরে রেখে দলগুলোকে আরও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে পাশে থাকার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন ড. ইউনূস। এ ছাড়া উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত বুধবার বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এমন পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠে যে, তাহলে কি আবারও মাঠের কর্মসূচিতে যাচ্ছে দলগুলো? সেই প্রশ্নেরই উত্তর জানার চেষ্টা করা হয়েছে দলগুলোর কাছ থেকে।
জানা যায়, বিএনপি এখন চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির কর্মসূচি পালন নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। জুলাই-আগস্ট স্মরণে দলটির ৩৬ দিনব্যাপী যে কর্মসূচি চলছে, সেগুলোর সর্বশেষ কর্মসূচি হিসেবে আগামী ৬ আগস্ট ঢাকায় সর্ববৃহৎ ছাত্র-জনতার সম্মিলিত বিজয় মিছিল অনুষ্ঠিত হবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে জানতে চাইলে গতকাল শুক্রবার কালবেলাকে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলোর উদ্যোগে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূতির বিভিন্ন কর্মসূচি চলমান রয়েছে। ফলে এ মুহূর্তে বিএনপির কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
অবশ্য গত ২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে মর্মান্তিক হতাহতের ঘটনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গভীর শোক ও সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি দলের পূর্বঘোষিত অনেক কর্মসূচি স্থগিত করেন। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আগামীকাল দেশের ১০টি সাংগঠনিক বিভাগে গ্রাফিতি অঙ্কন। ২৮ জুলাই জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের উদ্যোগে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণে ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান এবং কেন্দ্রীয় যুবদলের উদ্যোগে রাজধানীতে আন্দোলনের ৬টি হটস্পটে গ্রাফিতি অঙ্কন। ২৯ জুলাই আমরা বিএনপি পরিবার ও মায়ের ডাকের উদ্যোগে বনানী মাঠে ‘গণতান্ত্রিক পথযাত্রায় শিশু’ এবং ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ইউট্যাবের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমাবেশ। ৩০ জুলাই হবে সাভারের আশুলিয়া থানায় লাশ পোড়ানোর স্থানে ‘নারকীয় জুলাই’ শীর্ষক গণসংগীত। আগামী ৩১ জুলাই জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের উদ্যোগে ঢাকাসহ সারা দেশে হবে মার্চ ফর জাস্টিস এবং রাজধানীতে মহিলা দলের উদ্যোগে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে নারীদের অবদান শীর্ষক আলোচনা সভা হবে।
এ ছাড়া ১ আগস্ট ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে রাজধানীতে জনসভা, ২ আগস্ট জনতার জুলাই-আগস্ট, জনতার কারফিউ…. শীর্ষক কর্মসূচি, ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্রদলের উদ্যোগে হবে ছাত্র সমাবেশ, ৪ আগস্ট যুবদলের উদ্যোগে ঢাকায় ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন ও আমার না বলা কথা’ শীর্ষক অনুষ্ঠান এবং ৫ আগস্ট সারা দেশের উপজেলা শাখায় বিজয় মিছিল। সবশেষে আগামী ৬ আগস্ট ঢাকাসহ সারা দেশে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪: ছাত্রজনতার বিজয় মিছিল’ হবে ঢাকায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ৬ আগস্টের বিজয় মিছিল কর্মসূচিকে মহাসমাবেশে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। বিজয় মিছিল ঘিরে সেদিন ঢাকায় স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনসমাগম ঘটানোর লক্ষ্য আছে দলটির। এর মধ্য দিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারিতে প্রতিশ্রুত জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর পরোক্ষভাবে এক ধরনের চাপও তৈরি করতে চায় বিএনপি। কারণ, সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঘোষিত না হওয়ায় দলটির এখনো শঙ্কা—নির্বাচন প্রলম্বিত, এমনকি বানচাল করারও ষড়যন্ত্র রয়েছে। এর অংশ হিসেবে সরকারের কোনো একটি অংশের সহায়তায় কেউ কেউ দেশে উদ্দেশ্যমূলক পরিস্থিতি তৈরি করতে তৎপর রয়েছে।
বিএনপির খুলনা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত গতকাল কালবেলাকে বলেন, গত বুধবার সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকদের একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও যুক্ত ছিলেন। তারেক রহমান আগামীতে কবে নাগাদ কী রকম কর্মসূচি দেওয়া যায় সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে বলেছেন। আমরা জুলাই অভ্যুত্থানের কর্মসূচি পালন করছি। বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আছে। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানও সামনে রয়েছে। ফলে এখনই কর্মসূচিতে যাওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এদিকে, মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে উদ্বেগ জানিয়ে গত মঙ্গলবার দেশের চলমান পরিস্থিতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দেন তারেক রহমান। তিনি বিবৃতিতে বলেন, ‘জাতির এই শোকের সময়ে আমি সব গণতন্ত্রপন্থি সহযোদ্ধাদের প্রতি শান্ত ও সংহত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। বিভেদমূলক সংঘাত বা মব উচ্ছৃঙ্খলতা বন্ধ করার লক্ষ্যে সহনশীলতা ও আত্মসংযমের ওপর ভিত্তি করে আমাদের একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনের কিছু সদস্যকে নিয়ে জনতা ও পুলিশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টির এবং সহিংসতা উসকে দেওয়ার উদ্বেগজনক খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব গোষ্ঠীর বাংলাদেশের ইতিহাসের এমন একটি শোকাবহ মুহূর্তকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর চেষ্টা থেকে বিরত থাকা উচিত। এর পরিবর্তে জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং সহানুভূতি ও একতা প্রদর্শনের দিকে আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত। বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে এবং প্রতিটি সংকটকে সংহতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে।
গত মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের। তিনি গতকাল শুক্রবার কালবেলাকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা মনে করি, সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য কোনো একটি মহল থেকে অপচেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পেছনে গোয়েন্দা সংস্থার দুর্বলতার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। আমরা বলেছি, বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের জায়গা আর হবে না। যেখানে ফ্যাসিবাদ সেখানে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ—এই হবে আমাদের স্লোগান। প্রয়োজনে আমরা মাঠে কর্মসূচি দেব। তবেই সেটি আরও ভেবেচিন্তে। অন্যদিকে, সরকারকে কঠোর হওয়ার আহ্বান এবং নিজেদের সমন্বয় রাখার কথাও বলেছি।
জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন কালবেলাকে বলেন, সচিবালয়ে ঢুকে হামলাসহ সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে যে, দেশে আবারও পতিত ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। এজন্য ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য ধরে রাখা অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, আমরা মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে তাদের বিভিন্ন দুর্বলতা ও ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেছি। অবশ্য আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ফের শক্তি সঞ্চয় করে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারবে না, সে ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা সবাই স্বীকার করেছে। তারা ফ্যাসিবাদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে প্রয়োজনে কর্মসূচি দেওয়ার কথা বললেও এখনই সেটি হচ্ছে না বলে জানান।